Published in “Prothom Alo.”
আশির দশকে এক কাব্যপ্রেমী জেনারেল প্রবাদ রচনা করেছিলেন যে ‘গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। ৩০ বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন শহর-নগরে বাস করে। এখন আমরা বলতে বাধ্য যে শহর চললে দেশ চলবে। তার মানে এই নয় যে একালে গ্রামের গুরুত্ব কমে গেছে। তবে শহর নিয়ে এখন চলছে নতুন তাড়না ও উদ্দীপনা।
ঢাকা এক গন্তব্যহীন শহর। অবাধ্য নগরায়ণে হোঁচট খাচ্ছে এর সম্ভাবনা। ঢাকা শহরের জটিলতার তালিকাটি দীর্ঘ—খোলা জায়গার ওপর আগ্রাসন, দূষণের হিংস্রতা, গৃহায়ণব্যবস্থায় করুণ পরিণতি, সামাজিক বৈষম্যের অবনতি, গণযোগাযোগে অচলতা আর সবচেয়ে বড় বিপদ পরিবেশের দ্রুত অবনতি। শহরটি একটি দেহ হলে এসব সমস্যা যেন তেমন ব্যাধি, যার উপশমের নিদান বড়ই অল্প। তাই সম্ভবত বছরের পর বছর ঢাকার গলায় পরতে হয় গ্লানির মালা—এটি পৃথিবীর সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহরের একটি।
এর পরিত্রাণ একটাই— রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে সুচিন্তিত ও সুষ্ঠু নগরের পরিকল্পনা। ঢাকার মতো জটিল শহরকে গোছানোর জন্য যে মেধা এবং নগরবিন্যাসে যে উঁচু মাপের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন, তার পরিবর্তে চলছে উল্টো এক তৎপরতা। শহরটির নিয়তি নির্ধারিত হচ্ছে উদাসীন আমলা ও স্বার্থচিন্তায় পরিচালিত ডেভেলপারদের হাতে। সুন্দর, ট্রপিক্যাল ও বাসযোগ্য শহরের বদলে তৈরি হচ্ছে এক অপশহর। তিনটি অপঘটনা ঢাকাকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে—ঢাকার ড্যাপকরণ, সংসদ ভবন এলাকাকে খাঁচায় বন্দী করা আর তিলোত্তমা করার নামে বেচারা শহরটির কুশ্রীতা সাধন। তিনটি ঘটনা আবার একই সুতায় গাঁথা।
প্রথম প্রণীত ড্যাপের উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকার সামগ্রিক পরিবেশের জন্য স্পর্শকাতর জলাভূমি, কৃষিজমি ও বন্যাপ্রবাহের এলাকাগুলো রক্ষা করা। এখন ড্যাপের কর্তারাই বলছেন, প্রখ্যাত উপদেষ্টাদের দেওয়া ড্যাপের রেখাচিত্র ত্রুটিপূর্ণ। তাঁরা যেগুলোকে জলাভূমি বলেছেন, তার সবটা জলাভূমি নয়। শুনতে পাচ্ছি, এখন নতুন ড্যাপ আসছে। আর তাতে লিপ্ত হয়ে আছেন ডেভেলপার গোষ্ঠীর নেতারা। অন্যদের অগ্রাহ্য করে ডেভেলপার গোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া অচিন্তনীয়, শহরের পরিবেশ বিনষ্ট করার ব্যাপারে যারা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। অন্য কোনো শহরের পরিকল্পনায় এমন ব্যাপার কখনো দেখিনি।
ড্যাপের দ্বন্দ্বমুখর দিকটা বেশ সরল। ঢাকা শহরে জমি যেখানে হীরকখণ্ডের চেয়ে দামি, সেখানে জলাভূমি নির্দিষ্ট করা মানে জমি তৈরির কারবার এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনৈতিক মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থা কমানো। তাই তো ড্যাপ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ফাঁকে একরের পর একর জলাভূমি আর বন্যাপ্রবাহের এলাকা নির্বিচারে ভরে ফেলা হয়েছে। মুক্তবাজারে বাড়িঘরের বেচাকেনা কমিয়ে দেওয়ার কথা আমরা বলছি না। সেটি মোটেই সম্ভব নয়। এই মাটি ভরাট করা, প্লট করা ও দালান তোলার পদ্ধতির বাইরে গত ২০ বছরে ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেশগত ও হাইড্রোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যকে অন্তর্ভুক্ত করে আবাসনের নমুনা দেখিনি। আপাতদৃষ্টিতে ড্যাপের অবস্থান ডেভেলপারবিমুখ আর ডেভেলপারদের পদ্ধতি পরিবেশবিরোধী। এই দুইয়ের মাঝখানে কি কোনো বুদ্ধিদীপ্ত উদ্ভাবনীর অবস্থান নেই?
এখানেই আসছে লুই কানের নকশা করা সংসদ ভবন ও সংলগ্ন এলাকা বা ক্যাপিটাল কমপ্লেক্স। সেই ১৯৬৩ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহর থেকে দার্শনিক ভাবাপন্ন স্থপতি লুই কান এসেছিলেন সংসদ ভবন ও তার সংলগ্ন ভবনগুলোর পরিকল্পনা করতে।
তাঁর আরেকটি অবদান নিয়ে আমরা কথা বলি না। তিনি বাড়িঘর, উদ্যান, গাছপালা, হ্রদ—সবকিছু নিয়ে ঢাকাবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন একটা সামগ্রিক নাগরিক পরিবেশ।
পানির মধ্য থেকে সংসদ ভবন উঠে আসছে। আশপাশে সাজানো বাড়ি, হাঁটার পথ, বসার জায়গা, সারিবদ্ধ গাছ, নির্মল শোভা—কান সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালির একটি শহর। একদিকে শহর আর প্রকৃতিকে সাজানো, অন্যদিকে ক্লান্ত নগরবাসীর জন্য উজাড় করা স্থাপত্যিক পরিবেশ। এ রকম সিভিক ও আরবান স্পেস গঠনের জন্য কানের কাজের গুরুত্ব আরও বেশি। একজন ভিনদেশি এসে দেখিয়ে গিয়েছেন জল-স্থল নিয়ে কীভাবে একটি শহর সাজানো যায়। দুঃখজনক হলো, আমাদের উপদেষ্টা ও অত্যুৎসাহী নীতিনির্ধারকদের মনে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি।
বরং পৃথিবীর এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিয়ে এখন চলছে এক তামাশা। সংসদ ভবনের অভ্যন্তরীণ পরিসর যাচ্ছেতাইভাবে বদলানো হচ্ছে। টেলিভিশন স্টেশন বসানোর নামে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে উত্তরের প্রেসিডেনশিয়াল প্রবেশদ্বার। আর নিরাপত্তার নামে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হচ্ছে জাল দিয়ে। নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ; তাই বলে এমন স্থূল ধারণা দিয়ে কানের অনন্য উপহারটি বিনাশ করে ফেলতে হবে! সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও তার সামনের বাগান থেকে ঢাকাবাসীকে বহু আগেই বিতাড়িত করা হয়েছে। এখন নিরাপত্তার নামে কঠিন খাঁচা তৈরি করে সে নির্বাসন পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।
এ সিদ্ধান্ত যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি পৃথিবীর আর কোনো সংসদ ভবন দেখেননি? ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার সংসদে গ্রেনেড হামলার পরও সেটি বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার কথা তারা ভাবেনি। জার্মান পার্লামেন্টে পুরোনো ভবনের ওপর নতুন একটি কাচের গম্বুজ আছে। সাধারণ মানুষ অবলীলায় সেই গম্বুজে উঠে নিচের সংসদ অধিবেশন অবলোকন করতে পারেন। বার্লিনের মতো জায়গায় সেই ভবনের নিরাপত্তাভাবনা আমাদের চেয়ে মোটেই কম নয়। কান তো পানিতে ঘিরে দিয়ে খুবই প্রাকৃতিকভাবে আমাদের সংসদ ভবনের নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করেছেন।
লুই কানের নির্মাণের দর্শন হলো, সংসদ ভবন সাংসদদের জন্য আর এর আশপাশের পরিসরটি নাগরিকদের জন্য। কান ধারণা করেছিলেন, সংসদ ও নাগরিকদের মধ্যে থাকবে নিবিড় সম্পর্ক। বাইরের বাগানে ও প্লাজায় মানুষের আগমন আর ভেতরে সংসদে মানুষের জন্য নীতিনির্ধারণ। এমন উচ্চতর উদ্ভাবনী সম্পর্ক, যা আমাদের গর্বে ভরিয়ে দেয়, সেটি বিনষ্ট করা শুধু অন্যায়ই নয়, একটি সিভিক দুষ্কর্ম।
এবার তৃতীয় ঘটনা। টি-টোয়েন্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আগতদের মন ভোলানোর জন্য ঢাকার উত্তরে রাস্তার বিভাজকের ওপর শিল্পকর্মের নামে নির্মিত হয়েছে কুৎসিত কিছু ইটের বাক্স। সেগুলোর গায়ে শৌচাগারের টাইল। শুনতে পেলাম, একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ডিজাইন করা এই কুৎসিত কর্ম তুলে ফেলতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এখানেও প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে?
যদি বিজ্ঞাপনী সংস্থা আর ডেভেলপাররাই ঢাকাকে গোছানোর ভার নিয়ে নেয়, তাহলে নগরবিদদের আর কী দরকার?