Kazi Khaleed Ashraf

WRITINGS

নগর নবায়নের বয়ান

September, 2020

Published in  “Prothom Alo.”  

 

ঢাকা একটি উজ্জ্বল উদ্দীপনার শহর, প্রাণপ্রাচুর্যের জায়গা, তা সত্ত্বেও এমন কিছু ঘাটতি আছে যেগুলো প্রতিনিয়তই ঢাকাকে পৃথিবীর বাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে নিচের স্তরে রেখেছে। প্রথমটা হল দেড় কোটি মানুষের বাসস্থানের জন্য অপ্রতুল পাবলিক স্পেস। অর্থাৎ সবার ব্যাবহারের জন্য, বিনোদনের জন্য, গোছানো খোলামেলা জায়গা তার অভাব। আর দ্বিতীয়টা হল, পরিকল্পিত হাউজিং বা গৃহায়ন। বাসস্থানের জন্য একটা সুন্দর বাড়ি ডিজাইন ও তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সেই বাড়ির প্রেক্ষিত ও ক্ষেত্রটাও ডিজাইন করা। প্রয়োজন এক বাড়ির সাথে আরেক বাড়ির সম্পর্ক রচনা করা যাতে করে একটি পাড়া বা সমাজ গড়ে উঠে। এরকম ব্যাবস্থারও বড় অভাব ঢাকা শহরে।

 

নগর নবায়ন, বাসযোগ্য ও আরও উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে এই দুটি সংকটের দিকে আমাদের গভীর মনোযোগ দেয়া দরকার।

 

গত বছর সরকার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়। ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে কিভাবে পরিকল্পিতভাবে পরিবর্ধন করে একটি পাবলিক স্পেসে পরিণত করা যায়, সেটার সুচিন্তিত ব্যাবস্থা নেয়া। কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে জাতীয় পর্যায়ে আর্বান ডিজাইন প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয় এবং একটি আকর্ষণীয় ধারণার প্রস্তাবনাকে নির্বাচন করা হয়। আমাদের প্রত্যাশা নির্বাচিত প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকাবাসী উপহার পাবে একটি অভিনব পাবলিক স্পেস।

 

পুরনো জেলখানার মতনই ঢাকার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ও বিশিষ্ট এলাকা আজিমপুর হাউজিং। জেলখানার মোট এলাকা ৩০ একর। আজিমপুর প্রায় ৫০ একর। তাছাড়া আজিমপুর পুরনো ও নতুনতর ঢাকার ঐতিহাসিক সীমানা। পঞ্চাশ দশকে আধুনিক গৃহায়ন পরিকল্পনার নমুনা হিসেবে ঢাকা শহরে আজিমপুরের অবস্থান ল্যান্ডমার্কের মত। বহু সরকারী কর্মচারীরা ও তাদের পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এই আজিমপুর।

 

এ মুহূর্তে আজিমপুর হাউজিং এলাকার সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে সরকারী স্থপতি ও প্রকৌশলীরা এ প্রক্রিয়ায় যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা বহুলাংশেই সমালোচনার সামিল।

 

আমরা যতটুকু জানি বা দেখছি পুরনো আবাসনগুলোর একটা একটা করে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে এবং তার পরিবর্তে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে।    

 

বাড়িগুলো জীর্ণ হলেও আজিমপুর এলাকার গুরুত্ব অপরিসীম। নবায়ন তো হবেই, প্রয়োজনে পুরাতনকে ভাঙতে হবে, তবে কোন পন্থায়? পুরাতনকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন না করে কিছুটা অবিকৃত রেখে নতুনের সাথে একটা অভিনব সম্পর্ক হবে কি? নতুনই বা কেমন হবে এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।

 

একসময়কার আধুনিক পরিকল্পিত সমষ্টি আবাসনের নিদর্শন আজিমপুর। তখনকার মহাপরিকল্পনা আহামরি কিছু নয়। বেশিরভাগ বাড়িগুলোই একরকম সাধারণ। এরই মাঝে আবার কিছু অসাধারণ ডিজাইন আছে। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের পথ প্রদর্শক মাজহারুল  ইসলামের ডিজাইন করা দুটো টাইপের বাড়ি আছে যেগুলো স্থাপত্যশৈলী ও বসবাসের ধ্যান-ধারণায় অভিনব। বছরের পড় বছরের অবহেলার কারনে বাড়িগুলো ম্রিয়মাণ, তবে পুনঃনবায়ন করে নতুন ব্যাবহার প্রবর্তন করলে বাড়িগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য হতে পারে আধুনিক ইতিহাসের অনুপ্রেরণামূলক সাক্ষ্য। দুর্ভাগ্যজনক কথা হল স্থাপত্য অধিদপ্তরের চলমান পরিকল্পনায় মাজহারুল  ইসলামের বাড়িগুলো বুলডোজারের  অপেক্ষায়। আরও দুঃখজনক, আমরা স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু চোখের নিমিষে কোন বাছ-বিচার না করে তার কীর্তি গুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করি না।

 

আমরা যতদূর বুঝতে পারছি স্থাপত্য অধিদপ্তর সুচিন্তিত মহাপরিকল্পনা ছাড়া এগিয়ে চলছে। যদি থেকেও থাকে তা পাবলিকের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। নতুন পরিকল্পনার আংশিক যা দেখেছি তাতে কোন অনুপ্রেরণা জাগায় না। মনে হয় আনাড়ি হাতের কাজ। বহুতল ভবনের নামে যে কয়েকটা বাড়ি নির্মিত হয়েছে সেগুলো স্থাপত্যশৈলী ও  বাসগৃহ ভাবনায় সাধারণ মানের। যাঁরা এই কাজে ব্রত হয়েছেন তারা এই জায়গার মূল্যবোধ ও প্রভাব ভালভাবে বুঝতে পারছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তরিঘরি ও যেমন-তেমন করে স্থাপত্যশৈলী সম্ভব না। বরং এভাবে ঢাকা হারাবে একটি মহাসুযোগ।

 

উন্নত দেশ হবার লক্ষ্যে আমাদের শহর-নগরের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন দরকার। আরও প্রয়োজন সৃষ্টিশীল, যত্নবান নগর পরিকল্পনা। বর্তমান ঢাকা শহরকে এখনো পরিচ্ছন্ন, বাসযোগ্য ও উপভোগের জায়গায় রূপান্তরিত করা যায়। যেসব স্থপতি, প্রকৌশলী ও অন্যান্য পেশাদাররা শহর মেরামত ও  রূপান্তরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরকে হতে হবে আরও বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃষ্টিশীল। বুঝতে হবে শহর পরিবর্তনের ইতিহাস ও পদ্ধতি। তাদের জানা থাকলে ভালো আজিমপুরের মতন এলাকা নিয়ে অন্যান্য শহরে কিসব দারুণ, দৃষ্টান্তমূলক নাগরিক ও স্থাপত্যিক চর্চা হয়েছে।

 

যেমন লন্ডন শহর, পুরনো আর নতুনের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। একে অন্যের পরিপূরক। এরই জন্য লন্ডন শহর ভীষণভাবে বাসযোগ্য ও উপভোগ্য। লন্ডন শহর যদি সেখানকার পুরনো বাড়িগুলো সব ভেঙ্গে ভেঙ্গে আগাতো, তাহলে শহরটা দেখতে হত বসুন্ধরা বা উত্তরার মতন। আমরা লন্ডন হতে চাই না বা হবার প্রয়োজনও নেই। তবে ঢাকা তার নিজের মতন করে পুরনো-নতুন মিলে এক অনবদ্য শহর হতে পারে। এটা হতে পারে সঠিক কারিগরের হাতে। যারা শহরের মার্জিত সংমিশ্রণ বোঝেন — কি করে পুরনো আর নতুন মিলে আরও নতুনতর পরিবেশ রচনা করা যায়। যারা পুরনোকে সংবেদনশীল ও সূক্ষ্মভাবে নবায়ন করার দক্ষতা রাখেন।  আর নতুনকে কিভাবে আরও অভিনব করা যায় সেটা করার জ্ঞান ও মেধা রাখেন। সব থেকে দুঃখজনক আর অমার্জনীয় কাজ হবে পুরনোটা কাজ করছেনা বলে সেটাকে তরিঘরি চূর্ণ করা এবং তার পরিবর্তে গতানুগতিক গোছের স্থাপনা গছিয়ে দেয়া। যার মাসুল শহরকে দিতে হবে বহু বছর।

শহর নবায়নের বহু দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ আছে। পশ্চিম বার্লিনের পুনর্গঠন নগরবিদদের কাছে পরিচিত। যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া, অতঃপর নতুন বাড়িঘর তৈরি, তারপর বাড়িগুলোর ক্ষয়, এটাই ছিল এই এলাকার পরিচিতি। ১৯৮৯ সনে বিশিষ্ট স্থপতি জোসেফ পল ক্লেইহুস-এর নেতৃত্বে ঐ এলাকার মহাপরিকল্পনার কাজ হাতে নেয়া হয়। এলাকার প্রাক যুদ্ধ আর্বান কাঠামো সুসংগঠিত করে নতুন ধাঁচের হাউজিং প্রস্তাব করা হয়। বাড়িগুলো ডিজাইন করার জন্য ক্লেইহুস বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ইয়োরোপীয়ো স্থপতিদের আমন্ত্রণ করেন। রচিত হয় হাউজিং ডিজাইনের উৎসব। একে অপরের সাথে সম্পর্কিত নতুন হাউজিং, জনসাধারণের জন্য হাঁটাচলার পথ, সবার ব্যাবহারের জন্য পাবলিক স্পেস নিয়ে নবনির্মিত এলাকাটি হয়ে উঠে বার্লিন শহরের গর্ব। একইসাথে শহরের ঐতিহ্য হয় বলিষ্ঠ ও নতুন মাত্রার জন্য শহর লাভ করে নবপ্রান।

 

আধুনিক চীনের ভৌতিক প্রগতি বহু ধারায় রচিত। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্তরনের ব্যাপারে চীনের উদাহরণ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। নব্বই এর দশক থেকে শুরু হয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান ও তেজী অর্থনীতির চাপে নগর উন্নয়নের নামে বহু পুরনো বাড়িঘর ও ঐতিহ্যবাহী পাড়া-এলাকা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তরিঘরি করে পশ্চিমা কায়দায় এই নগরায়ন সমালোচনার মুখে পরে। টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এরপর থেকে চীনের নগর নবায়ন আরও সুচিন্তিত ও সংযমী হয়ে উঠেছে। পুরনো ও নতুন মিলে সূচিত হয় এক তৃতীয় সম্ভাবনা।

 

যত্নবান রূপান্তরের একটি উদাহরণ সাংহাই শহরের শিনটিইয়ান্ডি এলাকা। এলাকাটির সংবেদনশীল নবায়নের জন্য এমন মহাপরিকল্পনা নেয়া হয় যাতে নতুন পরিবর্ধনের ভিতর পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলো সংরক্ষণ করা হয় এবং রক্ষা করা হয় পুরনো পাড়ার লেআউট। অনেক ক্ষেত্রে পুরনো বাড়িগুলোতে আনা হয় নতুন ব্যাবহার। সাংহাই শহরের নগরকর্তারা বুঝতে পারেন পুডং স্টাইলে আমেরিকান কায়দায় নগরায়ন এগোবার একমাত্র পন্থা নয়।

 

একটি ম্রিয়মাণ জায়গাকে কিভাবে নতুন রূপে রূপায়িত করা যায়, তার জন্য প্রয়োজন নগরের প্রতি আন্তরিকতা ও ইতিহাসের প্রতি সংবেদনশীলতা। চার পাঁচ তলা বাড়ি ভেঙ্গে তার বদলে বহুতল বাড়ি তো হতেই পারে। তবে প্রশ্ন হবে সেরকম কয়টা বাড়ি হবে এবং তা কত উঁচু হবে? একটা বাড়ির সাথে সাথে অন্য বাড়ির সম্পর্ক কি হবে? উঁচু বাড়ির মাটি ঘেঁষা নিচতলা ল্যান্ডস্কেপের সাথে কি ধরনের আত্মীয়তা তৈরি করবে? আজিমপুরের নতুন বহুতল বাড়িগুলো দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না এই প্রশ্নগুলো মনে রেখে ডিজাইন করা হয়েছে। বাড়িগুলোর ডিজাইন অবয়ব দেখেও কোন উৎসাহ ও আশা জাগছে না যে পুরনোকে ঝেরে মুছে ফেলে একটা উচ্ছ্বসিত ও ডায়ানামিক নবায়নের দিকে যাচ্ছি। তবে এখনো সুযোগ আছে বর্তমান মহাপরিকল্পনা সংস্কার করে আরও যুগোপযোগী ও চিন্তাপুর্ন রূপ দেয়া যার ফলে নতুন আজিমপুর হতে পারে ঢাকার শহর উজ্জ্বল করার জন্য আরও একটি উপহার।