Kazi Khaleed Ashraf

WRITINGS

আগামীর ঢাকা

October, 2017

Published as text for exhibition “Agamir Dhaka,” 2017

 

আমাদের ঢাকা শহরে আমরা অনেক কিছু চাই। আমরা ঢাকাকে পেতে চাই সুষ্ঠু আর উপভোগ্য শহর হিসেবে। সবার জন্য চাই আবর্জনা মুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত আবাসন আর যাতায়াতের গতিময়তা। চাই শ্রেণী, গোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটা সুস্থ ভদ্র পদচারণের শহর।

 

যদিও রুগ্ন নগরী নামে ঢাকার একটা পwiচয় আছে, ঢাকা আসলে ভীষণ গতিময় এক নগরী। যানবাহনের অবস্থা হয়তো নারকীয়, জলাবদ্ধতার দরুন পথঘাট হয়তো অচল হয়ে পড়েছে, পায়ে হাঁটা দৃশ্যতই অসম্ভব, তারপরও ঢাকা হ‡Z যাছে এশিয়ার সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। “ইউকে ইকোনমিক আউটলুক”-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকার জিডিপি হবে ২১৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং পৃথিবীর ১৫০টি নগরের অর্থনীতির মধ্যে ঢাকার অবস্থান হবে ৪৮তম, যেখানে ঢাকা থাকবে ব্রাজিলিয়া, রোম, করাচি ও মন্ট্রিয়লের উপরে।

 

যদি যানবাহনকে নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে আনা যেত, যদি আবাসনব্যবস্থার জন্য গৃহীত হত একনিষ্ঠ উদ্যোগ, যদি নাগরিক ও সর্বসাধারণের স্থানগুলোর পর্যাপ্ত দেখভাল হত, এবং যদি জল ও সবুজের উৎসগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যেত, তবে ঢাকা হয়ে উঠত চমৎকার, বাসযোগ্য স্থান। আমরা মনে করি একটা সুন্দর ও অভিনব ঢাকা এখনও সম্ভব, এবং তা হবে সাবধানী, মাপমাফিক ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে।

 

নগর মানে গতিময়তা। একটি নতুন ও নবজীবন সঞ্চারণশীল শহর হিসেব টিকিয়ে রাখতে হলে এর যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্বিনস্ত করা আশু প্রয়োজন। অনেক বেশি অবকাঠামোর নির্মাণের বাধা ছাড়া নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব। আমরা এরকম তিনটি খাতকে চিহ্নিত করছি: রেলপথ, বাসপথ ও নৌপথ বা পানিপথ। ঢাকার যোগাযোগ সমস্যার সমাধান একটিই: গণ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বা ম্যাস ট্রানজিট, যা কম পরিবহনের মাধ্যমে বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম। বৃত্তাকার রেলপথের অথবা সড়কপথের জন্য উপযুক্ত অবস্থা রয়েছে। বৃত্তাকার রেলপথের লাইনের সাথে নগরীর একটি নতুন ও নবজীবন সঞ্চারকারী সংযোগস্থল সৃষ্টির সুযোগ হতে পারে। নগরের গণযোগাযোগের জন্য বাস এখনও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা; কিন্তু এর কার্যকরিতা দুর্বল। প্রয়োজন, নির্দিষ্ট রুটে অসংখ্য যাত্রী বহন করতে পারে এরকম পরিবেশ-বান্ধব পরিবহন চালু করা, নির্দেশিত রুটে বিশেষ নকশার বাসস্ট্যান্ড তৈরী করা।

 

পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত ঢাকা নগরীর ক্ষেত্রে নৌপথভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো সবচেয়ে স্বাভাবিক উপায়। সুসংবদ্ধ এবং বিস্তৃত নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা - নদীসমূহ,খালসমূহ এবং তাদের প্রান্ত সীমাগুলোর ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের একটি বাস্তবক উপায় হতে পারে। যেভাবে আমরা নদীবিমুখ হয়েছি, একটি শক্তিশালী নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে তো ঘুরিয়ে আনা যায়। যেহেতু নৌ স্টেশনগুলো নদীতীরবিত্তিক উন্নয়ন এবং প্রগতির তাড়নার কেন্দ্রস্থল হতে পারে, তাই বিশৃঙ্খল উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্যে এ ধরণের কেন্দ্রস্থলগুলোর পরিকল্পনা সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত।

 

একটি শহরের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হলো আরবান স্পেস। শুধুমাত্র দালান দিয়ে শহর গড়ে উঠে না। দালানগুলো ও উম্মুক্ত স্থান মিলে একটি কাঠামো গঠন করে। উম্মুক্ত স্থানগুলো বিভিন্ন ধরণের এবং বিস্তৃত এলাকাব্যাপী থাকতে পারে, আনুষ্ঠানিক থেকে অনানুষ্ঠানিক, বৃহত্তর স্তর থেকে ঘনিষ্ট স্তর পর্যন্ত, শেরেবাংলা নগরের দক্ষিণ পাঁজা থেকে গাউছিয়া মার্কেটের খোলা জায়গা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। বড় উম্মুক্ত  স্থানগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে জনসমাবেশের স্থান, উদ্যানসমূহ,হৃদ অথবা নদীতীর। ছোট উম্মুক্ত স্থানগুলো হতে পারে দুটো রাস্তার মিলন, ফুটপাথের গাছের নিচে জায়গা অথবা একটা প্রশস্ত ফুটপাথ। একসময় ঢাকা নগরীর সমার্থক ছিল বৃক্ষসমাহার, ফুল ও সুগন্ধপ্রদায়ী বৃক্ষ, ঋতুনির্দেশক গাছপালা,যা সব মিলে নিশ্চিত করত একটি মনোরম ও স্বাস্থকর পরিবেশ। ঢাকা নগরীর জলবায়ু  একে উদ্যানের ন্যায় শহর হিসেবে গড়ে উঠার অনুপ্রেরণা দেয়, যেটি হবে একটি বৃক্ষ, ফুল ও পর্ণরাজির শহর।

 

ফুটপাথ হচ্ছে একটি সভ্য নগরীর সর্বোচ্চ মাপকাঠি। ঢাকাকে গোছাবার জন্য প্রথমেই আমাদের একটা সত্য মেনে নিতে হবে – পায়ে হাঁটা শহর আমাদের মৌলিক অধিকার। শহরের পদচারণ পি পদব্রজন একটি নাগরিক ম্যান সংস্কৃতি নির্ণয় করে। নাগরিক পথচারীর ব্যবহারের নিমিত্তে গড়ে ওঠা বীথিকা (দুই পাশে বৃক্ষরাজি শোভিত প্রশস্ত রাস্তা), প্রোমেনাড, নদীর পাড় এবং সাধারণ ফুটপাথ, যেগুলো সকল সভ্য নগরীর প্রধান বৈশিষ্টসূচক চিহ্ন, সেগুলো ঢাকা নগরীতে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। একটি সফল পথচারী-কেন্দ্রিক অবকাঠামো বলতে বুঝায় জনযোগ্য ব্যবস্থা, যেমন রেলপথ, বাস, ভ্যান, ট্রাম, ফেরি এবং জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত স্থান ও সহজভাবে হাঁটার পথ। সুষ্ঠু হাঁটার ব্যবস্থা থাকলে অনেকেরই মোটরগাড়ি চালানোর প্রয়োজন হবে না।

 

আমি সাবলীল ভাবে হেঁটে চলে যাব এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। গন্তব্য না থাকলে ও হাঁটতে হাঁটতে খুজে নেব শহুরে চত্বর, লেকপার, নদীরপার, মাঠ, ঘাট, পার্ক বা ঝিলিমিলি বটের ছায়া। আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব পাঠাগার, যাদুঘর, মিলনায়তন সন্নিবেশিত নানান পাবলিক দালান কোঠায়।

 

ঢাকাকে নতুন ভাবে গোছাবার তাড়নায় আমরা দুটো এলাকার ভাবনা-চিত্র পরিবেশন করছি। ঢাকার দুই মেরুতে দুই রকম পরিবেশ ও গঠন – একদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর পার ঘেঁষা পুরাতন ও নুতুনের আবেষ্টন, আর অন্য দিকে গুলশানে নতুন থেকে নতুনতর পরিবর্তনের বিন্যাস। দুটো এলাকাতেই অভাব রয়েছে উন্মুক্ত পরিসরের, সাবলিলভাবে হাঁটা চলার ব্যাবস্থার। শহরে হাঁটা চলা ও উন্মুক্ত জায়গা, দুটো পরস্পর সংশ্লিষ্ট। ঊন্মুক্ত জায়গা বা পরিসর মানে ওপেন স্পেস, পাবলিক স্পেস, সিভিক স্থানসমুহ। যে কোন শহরের ভাল-মন্দের মাপকাঠিতে, উপভোগ্য-বিড়ম্বনার তারতম্যে সবথেকে প্রথমে এই পাবলিক স্পেসের অবস্থা।

 

ঢাকা শহরে এরকম ব্যবস্থা আপাতত অবর্তমান। অথচ এগুলো ছাড়া ঢাকাকে বলা যাবে না ভদ্র কিংবা আধুনিক শহর। আর এই সব চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলনই হোল আমাদের গুলশান আর বুড়িগঙ্গার ভাব-চিত্র।

 

বুড়িগঙ্গার উন্নত নদীর তীর

 

ঢাকা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার উপহার। ঢাকা এই মৌলিক সত্যটা ভুলে গেছে আর ভুলে গেছে যে শহরটি পৃথিবীর সবচেয়ে গতিশীল পানিপ্রবাহের সাথে জড়িত। ঢাকা হল তিনটি নদী ও একটি পরিবর্তনশীল প্রকৃতি পরিবেষ্টিত তরল ভূমিস্তুপ। ঢাকার জন্য একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে পানির প্রান্তসীমা থেকে, যেখান থেকে ঢাকার যাত্রা হয়েছিল।

 

সদরঘাটে পুনরায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি শুধু পুরোনো ঢাকার জন্য নয়, সমগ্র ঢাকার উন্নয়নের প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। সদরঘাট ঢাকার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর একটি। তবে একটি ঐতিহাসিক নগর সভ্যতার নিদর্শন থেকে এটি এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূষণের শিকার। সুষ্ঠু ও চিন্তাপূর্ণ পরিকল্পনায় সদরঘাট যেকোনো উন্নত শহরের সম্মুখে গড়ে ওঠা নদীমুখে রূপান্তরিত হতে পারে।

 

নদীমুখী পরিকল্পনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে নদী তীর গড়ে তোলা। এই বিশেষ এলাকার থাকবে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো গাছপালায় ঘেরা নদীর তীর, পাশ দিয়ে প্রশস্ত হাঁটার পথ, যেটা গিয়ে মিলবে কোনো ঐতিহাসিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সাথে। উদ্যান, বাগান এমনকি ভাসমান ব্যবস্থাও এ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়া সুদূরপ্রসারী কর্মকান্ডের মধ্যে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা, ঐতিহাসিক শোভাযাত্রা, ভাসমান রেস্তোঁরা বা বাগান এবং পর্যটনভিত্তিক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

 

নদী তীরের জন্য যেটি প্রথমে আবশ্যক সেটি হলো নদী। এর উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য নদীর ছোট বড় খালগুলির পুনঃসংস্করণ প্রয়োজন।

 

হাঁটাপথ

শহরের যানজট, অলি-গলি পেরিয়ে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ধরে এগিয়ে গেলে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে থাকবে বাধানো হাঁটাপথ। সবুজ গাছে ঘেরা নিরবিচ্ছিন্ন পথের ধারে নিরিবিলি বসার জায়গা, আর ছোটো ছোটো চত্বর। শীতের শান্ত জল, বর্ষার ঘোলা জল, বন্যার নতুন জল, সবার জন্য সাজানো সিঁড়ি। ছোট্ট সংযোগ সেতু পেরলেই মুল হাঁটা পথের সাথে সংযুক্ত জেটিতে পাওয়া যাবে নৌকা, ওয়াটার বাস, স্পিড বোট। হেঁটে হেঁটে নদী পার হতে চাইলে নতুন পদচারি সেতু ধরে কেরানীগঞ্জ চলে যাওয়া যাবে। নদীর পারে জলের সরব উপস্থিতি সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। কাজ শেষে অনায়াসে বসে নদী দেখা যাবে। ভাসমান দ্বীপে নানান মৌসুমি ফুল হাতছানি দেবে। বর্ষার জল নেমে গেলে জেগে উঠবে চরের হাটা পথ, উঁচু ঢিবিতে যাওয়ার রাস্তা, ছোট্ট খাবার জায়গা। সবমিলিয়ে সাজান পরিপাটি আয়োজন। অনুষ্ঠানে-অনানুষ্ঠানে, একলা বা দল বেঁধে, সবার জন্য বুড়ীগঙ্গা তীরবর্তী হাঁটার পথ অবারিত প্রাঙ্গন।

পায়ে চলা গুলশান

 

গত পচিশ বছরে পুরো পালটে গেছে গুলশান আবাসিক এলাকা। আরম্ভের গুলশানে আমুল পরিবর্তন এসেছে। মুলতঃ আবাশিক এলাকা হিসেবে পরিকল্পিত হলেও, গুলশান এখন মিশ্র প্রক্রিতির পাড়া। আর গুলশান এভিনিউত বহুতল অফিস, চকচকে বানিজ্জ্য কেন্দ্র, অভিজাত দোকান-পাট আর রেস্তোরাঁ নিয়ে উৎকর্ষপূর্ণ স্থাপত্যর মেলা।

তবু ও একটা বড় অভাব। একটা শোভনীয় শহরের জন্য সবচেয়ে মৌলিক সিভিক প্রতিবেশ ও

পরিবেশ এর অভাব। ফুটপাথ বা পায়ে হাটার রাস্তা থেকে ও নেই। নেই কোন উল্লেখযোগ্য পাব্লিক স্পেস, যেখানে সমবেত হওয়া যায়, ঘুরে বেরান যায়, নাগরিক শোভা অবলোকন করা যায়। এক সময় যা ছিল- যেমন ডি, সি, সি, মার্কেট যার অর্ধেকটাই এখন পারকিং। পার্ক থাকলে ও দেয়ালে ঘেরা। গুলশানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে চলে যায় আধাবেলা। চলাচলের পথে বিঘ্ন তৈরি করা আর পথচারীর পথ রধ করে যত্রতত্র পারকিং।

অভিজাত ও পরিকল্পিত এলাকা হলেও গুলশানে গোছানো শহরের নমুনা দরকার। পাবলিক স্পেস, পার্ক ও হাটাপথ মিলে প্রয়োজন নতুন নাগরিক নেটওয়ার্ক। সিভিক বা পাবলিক স্পেস বলতে কি বোঝায়? সহজভাবে উন্মুক্ত পরিসর। তার মানে পায়ে হাঁটার, ব্যাবহার আর উপভোগ করার জায়গা। সেটা হতে পারে দোকানপাট, কাফে-রেস্তরা, অফিস ঘেরা জায়গা, অথবা সরাসরি হাঁটার পথ বা ফুট পাথ।

আমাদের ভাবনায় গুলশান এভিনিউ ধরে আমরা নতুন ভাবে সাজিয়েছি। প্রস্তাব করেছি হাঁটাপথের নেটওয়ার্ক। উপহার দিয়েছি নতুন ধরনের সিভিক স্পেস বা জনমানুষের জায়গা- যেখানে ছিল নিছক গাড়ী চলাচলের রাস্তা বা যেমন-তেমন গাড়ী পারকিং এর জায়গা অথবা হযবরল বাজার কমপ্লেক্স।

গাড়ী চলাচল ও পারকিং এর জন্য আমরা ভিন্ন চিন্তা করেছি। আমাদের ধারনা গুলশানের এই প্রস্তাবিত পদচারি ও যাতায়াত বাবস্থা নিয়ে আমরা যে ধারনা ও চিত্র পরিবেশন করেছি সেটা হতে পারে গোটা শহর গোছানোর উপযুক্ত নীতিমালা।

 

কেন্দ্রীয় ঢাকার লাইট রেল করিডর

 

ঢাকার যোগাযোগ সমস্যার সমাধান একটিই: গণ-যোগাযোগ ব্যবস্থা বা ম্যাস ট্রানজিট, যা কম পরিবহনের মাধ্যমে বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম।

গণপরিবহন-ব্যবস্থা শুধু পরিবহন চলাচলের সমস্যাকে ঘিরে আবর্তিত নয়। এটি নাগরিক সংস্কৃতি, পরিবেশ, অবকাঠামো ও সামাজিক গঠন নিয়ে নগরজীবনের সমন্বিত রূপ। আমরা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেননি ঢাকা শহর কোন দিকে বিস্তৃত হবে বা হওয়া উচিত এবং পরিবহন ও চলাচলব্যবস্থার সামগ্রিক আয়োজন কীভাবে করা হবে।

দেড় কোটি লোকের এ শহরে ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি চলাচলের পথে সব সময় বাড়তি সুবিধা পায়। এসব গাড়িই শাসন করে আসছে গণপরিবহনের নিয়মকানুন, তথা নাগরিক জীবনের কায়দাকানুন। গাড়ির সুবিধা দুমুখো। গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন মানুষের হাঁটার স্পৃহা কীভাবে নষ্ট করে দেয়, পদব্রজে হাঁটার ফলে নগরবাসীর পরস্পরের মধ্যে যে সামাজিক ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা কীভাবে গাড়ির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সর্বোপরি গাড়ির কারণে শহরের খালি জায়গা কীভাবে হারিয়ে যায়, তা নাগরিক গবেষকদের কাছে পরিষ্কার।

যেভাবে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে যতই নতুন রাস্তা বানানো হোক বা বিদ্যমান লেনগুলো সম্প্রসারিত করা হোক, তা দিয়ে চলাচল ব্যবস্থাপনা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। আলাদাভাবে একটি একটি করে যান চলাচলের ভিত্তিতে যত দিন পুরো পরিবহনব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, তত দিন সড়ক-মহাসড়ক, দ্বিতল সড়ক, চওড়া রাস্তা, এসবের কোনো কিছুই কাজে আসবে না। পরিবহন ও চলাচলের জন্য আরও রাস্তা বানানো দরকার, সে কথা ঠিক; কিন্তু ঢাকার মতো এমন জটিল যোগাযোগব্যবস্থা-সম্পন্ন শহরের ক্ষেত্রে কেবল গাড়ির রাস্তা বানিয়েই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

টোকিও, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, এসব শহর আধুনিক সংস্কৃতিসম্পন্ন নিখুঁৎ ও কার্যকর বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। কেবল গণপরিবহন ও হাঁটার ওপর নির্ভর করে তারা পরিপাটি সামাজিক শহর তৈরি করেছে। তারা যদি ওভাবে তাদের পরিবহনব্যবস্থাকে নির্বিঘ্ন করে তুলতে পারে, তাহলে আমরা কেন অন্যদিকে যাব? ঢাকা বিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও চলাচলসংকটে পড়া প্রথম শহর নয়। তবে সংকট মোকাবিলায় আমরা আরও ভালো পরিকল্পনা করতে পারি। সেটাতে কোনো  গণপরিবহনের বিকল্প নেই।

গণপরিবহন অন্তত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি খাত চিহ্নিত – সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথ। শহুরে গণপরিবহনের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী বাস চলাচলব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো যেতে পারে। বিদ্যমান যাত্রাপথগুলোয় বিপুলসংখ্যক যাত্রী আনা-নেওয়ার জন্য আর্টিকুলেটেড যান বা বিশেষ যাত্রীবাহী বাস চালু করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যাত্রীদের দ্রুত ওঠানো-নামানোর জন্য বিশেষ ধরনের বাসস্ট্যান্ড তৈরি করা যায়।

ঢাকা নদীমাতৃক ভূখণ্ড হওয়ায় ওয়াটার বাস ও ওয়াটার ট্যাক্সির মাধ্যমে একটি জলপথভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার পওন করা স্বাভাবিকভাবেই সবার কাম্য। বলা বাহুল্য, সাধারণ লোকজনের চলাচলের বাইরে নৌপথ আরও অনেক ভূমিকা পালন করে। নদীতীরবর্তী চলাচলব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নদীতীরে উন্নয়নমূলক এলাকা গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করার ক্ষেত্রে নৌচলাচল-ব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা যে একটি নদীবিমুখ শহরে পরিণত হয়েছে, একটি শক্তিশালী নদীভিত্তিক চলাচলব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সে চিত্র পাল্টে দেওয়া সম্ভব। শুধু যে ঢাকার চারপাশেই বৃত্তাকারে নৌপথ থাকতে হবে তা নয়, ঢাকার ভেতরের খাল-নালা ইত্যাদি সংস্কার করে সেগুলোর সঙ্গে বাইরের নৌপথের যোগাযোগ তৈরি করাও খুবই সম্ভবপর।

ঢাকার জন্য প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের আয়োজনকে জানাই সাধুবাদ। আমরা মনে করি মেট্রোরেলের পাশাপাশি ফিডার রেল করিডর চিন্তা করা যায়। সেরকমই আমাদের প্রস্তাব খিলক্ষেত থেকে ধানমণ্ডি-কলাবাগান পর্যন্ত লাইট রেল বা এলআরটি। পথিমধ্যে লাইনটা সংযোগ করবে গুলশান এলাকা, হাতিরঝিল, কাওরান বাজার ও পান্থপথ। প্রস্তাবিত মেট্রো লাইনের সাথেও হবে সংযোগ।

ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকার গনপরিবহনের জন্য এই এলআরটি লাইনটা হতে পারে সব থেকে কার্যকর। সেখানে গাড়ী বা বাসে করে গুলশান থেকে কলাবাগান যেতে লেগে যায় কম পক্ষে দেড় ঘন্টা, সেখানে এলআরটি-তে যাতায়াত করা যাবে আধ ঘণ্টায়। তাছাড়া এলআরটির দুটো গাড়ী  হলে বহন করতে পারে ৩০০ যাত্রী। সেরকম সংখ্যক যাত্রী বাসে যাতায়াত করলে লাগবে ছয়টা যান। এল, আর, টি নির্মিত হতে পারে স্বল্প সময়ে, স্বল্প বিঘ্ন ঘটিয়ে। বর্তমান রোড করিডরের মিডিয়ান ধরে এলআরটি-র উত্তলিত লাইন তৈরি করা যেতে পারে।