First published in “Chetanar Patra,” 1986, and republished in “Prothom Alo,” 2000
স্থাপত্য কি, স্থাপত্য কখন এবং কিভাবে হয় এ প্রশ্নগুলো মৌলিক। কিন্তু স্থাপত্য ও স্থপতিদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমরা কতখানি পরিষ্কার ধারনা বহন করছি? সফল স্থাপত্য সৃষ্টির জন্য একজন সংবেদনশীল স্থপতির কোন ব্যাপারগুলোর প্রতি সচেতনতা থাকা উচিত সেটা বিশ্লেষণ করেই এই রচনা। রচনার মূল অংশ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬-তে, "চেতনার পত্র"-র প্রথম সংখ্যায়।
জাপানের সমকালীন স্থাপত্য সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সমালোচক ক্রিস ফসেট একটি ঘটনার কথা বলেছেন। সেখানকার স্থপতিদের কোন সভায় একজন স্থপতি কোথা থেকে একটি বিড়াল ধরে এনে ঘোষণা করলেন, "এ বিড়ালটিকে আমি মেরে ফেলবো যদি না কেউ বলতে পারে স্থাপত্যের মানে কি।" বলা বাহুল্য বিড়ালটি মারা যায়। এই কিছুক্ষণ পরই দেখানে হাজির হন প্রবীণ স্থপতি মায়েকাওয়া। ঘটনার বিবরণ শুনে মায়েকাওয়া বিচলিত হয়ে যান। পায়ের জুতো খুলে তা মাথার উপর রেখে তিনি সভা থেকে বেরিয়ে যান। তখন সভায় একজন উক্তি করেন, "হায়, মায়েকাওয়া যদি দু মিনিট আগে আসতেন তাহলে বিড়ালটা বেঁচে যেত।"
আসলে স্থাপত্যের ব্যাপারটা কি? আমরা মানুষের কোন কীর্তিগুলোকে স্থাপত্য বলছি? কিসের ভিত্তিতে? অগণিত কাজের ভিতর যে গুটি কয়েকটা স্থাপত্যের পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, কিভাবে পৌঁছাচ্ছে? স্থাপত্যের কাজ কি? স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সমাজের কোন জিনিসটা প্রকাশ পায়? এ প্রশ্নগুলো নিয়েই ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী সাময়িকী “The Architectural Review” ১৯৭৬ সনে একটি বিতর্কের আয়োজন করে। বিতর্ক কয়েক সংখ্যা ধরে চলে তবে সেটার কোন সুরাহা করা যায়নি। যে কোন অনুভূতি সম্পন্ন স্থপতিকে এ প্রশ্নগুলো তাড়া করে বেড়ায়। সমস্যা হলো প্রশ্নগুলোর একেবারে সর্বসম্মত উত্তর বোধ হয় নেই। প্রত্যেক স্থপতিকে নিজ নিজ উপায়ে উত্তরগুলোর সন্ধান করে নিতে হয়। পৌঁছাবার রাস্তা কয়েকটি হতে পারে (বিতর্ক এখানেই), তবে পৌঁছাবার স্থান একটিই যার নাম স্থাপত্য। আর খুঁজে বের করার রাস্তাটা দীর্ঘ। নিরলস ও একনিষ্ঠ সন্ধান করেই রাস্তার শেষ মাইল স্টোন গুলো দেখতে পাওয়া যায়। তাই চণ্ডীগড়ের পরিকল্পনাকারী এ যুগের প্রসিদ্ধ স্থপতি ল্য কর্বুযিয়ে ভারতে তার কাজ সম্পন্ন করার পর যখন আহমেদাবাদ ত্যাগ করছিলেন তখন ভারতীয় স্থপতি দোশীকে বলেছিলেন, "Now I think I am an architect " ল্য কর্বুযিয়ের বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গেছে।
স্থাপত্যের যে কোন প্রাথমিক আলোচনার শুরু আশ্রয় (shelter) নিয়ে। আশ্রয় তৈরি করা, অর্থাৎ, প্রকৃতি এবং বৈরী পরিবেশ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা যে কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রাথমিক প্রচেষ্টা, হোক সে মানুষ বা অন্য কোন জীব। অন্যান্য জীবের আশ্রয়ের কাঠামো এবং তৈরির ধরন হাজার হাজার বছর ধরে একই রয়ে গেছে। মানুষের বেলায় সেটা ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছে। জীবকুলে মানুষের প্রাধান্য এখানেই।
মানুষের মৌলিক উদ্দেশ্য হল প্রাকৃতিক ও অন্যান্য উপাদান থেকে নিরাপদে এবং স্বস্তিতে থাকার জন্য পরিবেশকে তার নিয়ন্ত্রণে আনা যার ভিতর তার বিভিন্ন রকম কর্মকাণ্ড কার্যকরী এবং অর্থবহ হয়ে উঠে। মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন যতই বিশাল এবং জটিল হয়েছে এর প্রয়োজন ততই বেড়েছে এবং ততই জটিলতর হয়েছে। মানুষ প্রতিদিন হাজার হাজার বাড়ি তৈরি করছে। একটি শহরেই প্রতিদিন গড়ে উঠেছে শত শত বাড়ি যেগুলোর প্রত্যেকটি এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরির এবং প্রকৃতিকে সামলাবার উদ্দেশ্যে করা। এর সবগুলোই বিল্ডিং। কিন্তু এর কতগুলো স্থাপত্য? অর্থাৎ, চার দেয়াল আর ছাদ তৈরি করে রোদ - বৃষ্টি ঠেকালেই কি স্থাপত্য করা যায়?
তাহলে, একটা বাড়ি কখন বিল্ডিং-এর সীমানা পেরিয়ে স্থাপত্যের পর্যায়ে পৌঁছায়? স্থাপত্যে পৌঁছাবার কায়দাটা কী? এই মৌলিক ব্যাপারগুলো... কাছে খুব পরিষ্কার নয়। তাই আমরা এখনো পরিবেশ তৈরির আদি (primitive) ব্যাপার - রোদ বৃষ্টি ঠেকানো নিয়েই হাবুডুবু খাচ্ছি। আসলে, রোদ-বৃষ্টি ঠেকানোটা একটা উছিলা, একটা সুযোগ। মানুষের এই সাধারণ প্রয়োজনকে বাড়ি তৈরির কারিগর যখন সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে "অন্য কিছু" প্রকাশ করার জন্য তখনই বাড়িটা স্থাপত্যে পৌঁছাবার জন্য অভিলাষী হয়।
এই যে "অন্য কিছু" প্রকাশ করা এটা হয় মূলত চাক্ষুষভাবে। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা অর্জন করি অন্যান্য অভিজ্ঞতা। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা মানে চোখ দিয়ে অবলোকন করা এর জন্য প্রয়োজন আলো। হেঁটে চলতে গিয়ে আলোতে বিভিন্ন দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা মনে গেঁথে ফেলা এবং ভালো অথবা মন্দ লাগা অনুভূত হওয়া। স্থাপত্য হচ্ছে আলোতে বস্তুর পাণ্ডিত্য পূর্ণ, সুষ্ঠু এবং অনাড়ম্বর মূলক ক্রীড়া। কথাগুলো বলেছেন ল্য কর্বুযিয়ে।
আমাদের বাহ্যিক জগত বিভিন্ন রূপ এবং আকার (form and shape) দিয়ে তৈরি। আকার হচ্ছে কতগুলো সম্পর্কের দৃশ্যমান রূপ। সম্পর্ক হতে পারে এক বস্তুর সাথে আর এক বস্তুর আর এক ঘটনার সাথে আর এক ঘটনার। নান্দনিক বিচারে আকারগুলো হতে পারে সুন্দর অথবা অসুন্দর। প্রশ্ন জাগে সুন্দর বলি কেন, ভালো লাগে কেন? একটি গোষ্ঠীর শত শত বছরের সাংস্কৃতিক মতৈক্যে দাঁড়িয়ে যায় কোনটা সুন্দর, আবার অন্যদিকে সৌন্দর্য বেত্তারা অর্থাৎ শিল্পীরা, মানুষের অনুভূতির উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পরিবেশন করেন সুন্দরের নতুন নতুন স্বাদ।
আগে যেটা বলা হলো, যখন সম্পর্কগুলো এমনভাবে সাজানো হয় যে আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় এবং চিন্তার যন্ত্রটাকে চালু করে দেয় তখনই আমরা বলি সুন্দর। আমরা আপ্লুত হই। প্রকৃতিতে এরকম সম্পর্ক চারিদিকে। মানুষের তৈরি এরকম চাক্ষুষ সম্পর্ককে আমরা বলতে পারি শিল্প। আসলে মানুষের এই শিল্প তৈরির চেষ্টা কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়। শিল্প হচ্ছে দৃশ্যমান জগতটাকে মানুষের কাছে বোধগম্য করার প্রয়াস। অর্থাৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি ও কাঠামো কি, সেখানে মানুষের অবস্থান কোথায়, এবং এই অবস্থাটাকে আঁচড় কেটে, সংকেত এবং চিহ্ন দিয়ে, অর্থাৎ ছবি দিয়ে কিভাবে বর্ণনা (represent) করা যায়। মানুষের তৈরি চাক্ষুষ সম্পর্কগুলোকে আমরা বলি শিল্প। এর ভিতর পরিবেশ গড়ার সম্পর্কগুলোকে বলতে পারি স্থাপত্য। তাহলে স্থাপত্য একটা শিল্প। এটাই স্থাপত্যের মৌলিক এবং চরম কথা।
এক কথায়, স্থাপত্য অভিলাষী কাজগুলোতে কতগুলো সম্পর্ক স্থাপিত হবে। রূপ এবং আকারে। আলো এবং ছায়ায়। আকার এবং space -এ, শূন্যতা এবং পদার্থপূর্ণতায়, scale, proportion, texture, রেখা এবং রঙের ভিতর দিয়ে। সম্পর্কগুলো যখন এমন হয় যে আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় তখনই আমরা বলি স্থাপত্য সৃষ্টি হয়েছে। আর তখনই শিল্পের সৃষ্টি।
স্থাপত্য একটি শিল্প। চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের সাথে স্থাপত্যের ব্যবধান মাত্রায়। গুনগত ও সংখ্যাগত দু'দিকে দিয়েই। চিত্রশিল্প দ্বি-মাত্রিক, ভাস্কর্য ত্রি-মাত্রিক এবং স্থাপত্য বহুমাত্রিক। স্থাপত্যের সাথে সময়, জীবন ও জীবনবৃত্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অর্থাৎ, স্থাপত্য আরও জটিল।
একটা বাড়ি একটা বস্তু। একটা বাড়িকে আমরা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বা চারিদিকে ঘুরেই শুধু দেখিনা, আমরা এর ভিতর প্রবেশ করি। আমরা একে ব্যবহার করি, একে ছুঁই, কোন সময় এর ঘ্রাণ নেই। এটা আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই স্থাপত্য শুধু চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাই নয়, জীবন্ত অভিজ্ঞতাও বটে। স্থাপত্য একটি জীবন্ত শিল্প।
স্থাপত্য কাঠামোর ভিতর আমরা প্রবেশ করি, এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুর দূরত্ব এবং বস্তুর ভিতরও এক স্থান থেকে অন্য স্থানের দূরত্ব অনুভব করি। এখান থেকেই architectural space এর জন্ম। আর এটাই মূলত স্থাপত্যকে অন্য মাধ্যম থেকে জটিলতর করেছে। লুই কানের কথাতেই, "স্থাপত্য বিশেষ করে হচ্ছে space-এর সৃষ্টি এবং এখানেই অন্যান্য শিল্পের সাথে এর তফাত।"
তাহলে স্থাপত্যের মূল ভিত দুটো জিনিসের উপর: রূপ-আকার (form) এবং space। একটা আর একটার সম্পূরক। একজন স্থপতিকে একটা সফল নিদর্শন দাঁড় করাতে হলে এ দুটোর পরস্পর সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে বুঝতে হয়। স্থাপত্য হচ্ছে space-এর পর্যায়ক্রমিক বিন্যাস (sequence)। স্থপতির কাজ হচ্ছে সঠিক এবং উপভোগ্যভাবে এটাকে সাজানো। যেমন, কলসের আকারটাই তার সব নয়, তার ভিরকার শূন্য space-ই কলসকে দিয়েছে তার চরিত্র, তার ‘কলসত্ব’।
আকার এবং space-এর সঠিক বিন্যাসে যদি স্থাপত্য সৃষ্টি হয়, তাহলে আকার এবং space-এর সূত্র কি? কোন ঘটনা বা বিষয়ের উপর এটা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে? স্থাপত্যের দৃশ্যমান কাঠামো তৈরি করার এগুলোই মূল প্রশ্ন। এগুলার উত্তরই সচেতন স্থপতিরা সারা জীবন ধরে খুঁজে বেড়ান। আহমেদাবাদে ল্য কর্বুযিয়ের মন্তব্য এখন অর্থবহ মনে হয়।
স্থাপত্যের দৃশ্যমান কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটা জিনিস, যেমন— স্থান (site) ও পারিপার্শ্বিকতা, জল-বায়ু-আবহাওয়া, নির্মাণ সামগ্রী ও প্রযুক্তি, প্রোগ্রাম, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, এবং অর্থবহতা ও ভাব প্রকাশের তাগিদ। স্থপতিকে বুঝতে হয় যে স্থানে বাড়িটা তৈরি হবে সেখানকার ও তার আশেপাশের ভৌত গুণাবলী কি এবং একটু বড় করে দেখলে, আর স্থানটা শহরে হলে, সেখানকার কর্মকাণ্ড, সড়কপথ ও তাদের হয় জায়গাটার আঞ্চলিক আবহাওয়ার গুণাবলী, এবং কি ধরনের ব্যবস্থা নিলে বসবাসটা আরামপ্রদ হবে। যথোপযোগ্য নির্মাণ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি ও নির্মাণ সামগ্রীর বাছাইও প্রভাবান্বিত করবে স্থাপত্যগত সিদ্ধান্তগুলোকে। যেমন করবে প্রোগ্রাম, অর্থাৎ যে কাজে বাড়িটা তৈরি হবে, তার খুঁটিনাটি দিকগুলো এবং একে অপরের সাথে সম্পর্ক। সবচেয়ে অনুভূতিশীল ব্যাপার হচ্ছে সে অঞ্চলের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বোঝা, যাতে সম্পন্ন কাজটি পরিমণ্ডলের সাথে একাত্মতা লাভ করতে পারে।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বোধ্য দিক হচ্ছে অর্থবহতা। অর্থাৎ, বাড়িটা দেখে অবলোকনকারীর মনে কি ভাব বা ছবি (image) জেগে উঠছে এবং সেটা অন্য কিসের সাথে সম্পর্ক টানছে। এখানে স্থাপত্যের আর একটা দিকের কথা বলতে হয়— ভাব প্রকাশ করার জন্য, ভাবের উদ্রেক ঘটানোর জন্য, স্থাপত্যের ক্ষমতা।
স্থাপত্য আর ভাষার কাঠামোগত মিল রয়েছে। স্থাপত্যও একটি ভাষা যার নিজস্ব শব্দ রয়েছে, অক্ষর রয়েছে, রয়েছে বাক্য। মনের ভাব প্রকাশে ভাষার ক্ষমতার কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। ভাষার ভাণ্ডারেই জমা পড়ে আছে মানুষের শত শত বছরের অভিজ্ঞতা ও ধ্যান-ধারনা। তাই সমষ্টিগত কোন স্মৃতি (collective memory) বা ব্যপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোন ধারনা জাগাবার জন্য ভাষার ব্যবহার অপরিহার্য। ভাষায় ভাব জাগাবার জন্য যেসব কায়দা কানুন আছে, যেমন রূপক আর উপমার ব্যবহার, সেগুলো স্থাপত্যেও রয়েছে। এই কৌশলগুলো সচেতন, সঠিক এবং বোধগম্যভাবে ব্যবহার করে অবলোকনকারীর মনে বিভিন্ন ছবি দাঁড় করানো যায়। এই ছবির বিন্যাস সঠিক হলে স্থাপত্যগত কাজটি সমাজ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যথোপযোগ্য, অর্থবহ এবং উপভোগ্য হয়ে উঠে।
স্থাপত্যের ভাষা দিয়ে অনেকগুলো কথা বলা যায় অথবা অজ্ঞাতেই বলা হয়ে যায়। স্থাপত্যের ভিতর দিয়ে বোঝা যায় এটা কোন ধরনের সমাজ। আর বোঝা যায় সামাজিক কাঠামোতে স্থাপত্য আর পরিবেশের মর্যাদা কতটুকু। আর একটা বড় জিনিস যেটা স্থাপত্যের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় সেটা হল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। বিল্ডিং আমাদের দৈনন্দিন ও সাধারণ প্রয়োজন মেটায়। স্থাপত্যমণ্ডিত কাজ সাধারণের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদেরকে একটা উন্নততর ভবিষ্যতের স্বাদ দিতে পারে, আমাদের পরিবেশকে কত সুষ্ঠু ও সুন্দর করে গড়া যায় তার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে পারে— আমরা কিভাবে বসবাস করবো, আমাদের প্রয়োজনগুলো কিভাবে মেটাবো এবং সুখের সন্ধান কথায় পাবো।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমকালীন স্থাপত্য চিন্তা ও সৃষ্টিতে এখন চলছে বিরাট দ্বন্দ্ব। বিবাদমান গ্রুপগুলো বিভিন্ন মতবাদী ক্যাম্পে বিভিন্ন নামে বিভক্ত। Modernism late-modernism, post-modernism, historicism, deconstructivism এবং আরও কত কি। মনে হচ্ছে স্থাপত্য নামক সেই স্থানে পৌঁছাবার জন্য স্থপতিরা কোন বিশ্বাসযোগ্য পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। বরঞ্চ, ইউরোপ থেকে modernism নামে যে বিশ্বাসের স্তম্ভ তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা বহুলাংশেই ধ্বসে পড়েছে।
বেচারা modernism এখন আসামীর কাঠগড়ায়; ঊনোবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বিপ্লবী জোয়ার উঠে তার ঢেউ স্থাপত্য চিন্তাতেও এসে পড়ে। রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, মোট কথা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে নতুন ধ্যান-ধারণার জন্ম নেয় তা ইউরোপের তখনকার রক্ষণশীল ও ঘুনেধরা ব্যবস্থার একেবারে ভিত্তিতে আঘাত করে। স্থপতিরাও এই নতুন চিন্তা-ভাবনাতে প্ররোচিত হয়ে, চিত্রশিল্প ও প্রযুক্তির নতুন সম্ভাবনাগুলোকে পুঁজি করে এবং সমাজের নিত্য নতুন তাগিদ মেটাতে গিয়ে বাড়ি-ঘর, পরিবেশ এমনকি সমাজ ব্যবস্থার জন্য নতুন স্বপ্ন (vision) রচনা করতে থাকেন। তৈরি করতে থাকেন অসম্ভব সৃষ্টিশীল এবং আপাতদৃষ্টিতে অতীতের সাথে সম্পর্কচ্যুত নতুন দৃশ্যমান অনুভূতি। (visual sensibility) সৃষ্টি হয় form-এর নতুন প্রকাশভঙ্গী, space সাজাবার নতুন পন্থা এবং form আর space-এর নতুন বিন্যাস। মানুষের জীবন ধারণের জন্যও অতীতের সাথে সম্পর্কহীন এবং আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় ও সহজলভ্য নতুন সম্ভাবনা পরিবেশিত হয়। এ কাজে ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট, ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস, মিয ভাণ্ডার রো, ল্য কর্বুযিয়ে, আলভার আল্টোর মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিদের অবদান স্মরণীয়।
Modernism-এর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ দুটো—ইতিহাস বিমুখতা, এবং রূপ-আকারগুলোকে কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণ (যার নামকরণ করা হয়েছে “International Style” বা আন্তর্জাতিক রীতি)। এর ফলে যা হয়েছে সেটা হল modernism -এর কৌশল এবং চাক্ষুষ ছবিকে (visual image) বেদবাক্য ধরে নিয়ে, এর বিমুর্তিকরণ প্রক্রিয়াকে সহজ সরলীকরণ করে সারা পৃথিবী জুড়ে যা মাথা গজিয়ে উঠেছে তা প্রায় ক্ষেত্রেই হয়েছে একঘেয়ে ও বাক্সমার্কা।
স্থপতিরা এখন বুঝতে পারছেন যে modernism-এর নামে "আন্তর্জাতিক রীতি"- র সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যে স্থাপত্য প্রয়াস একসময় পুরনো গৎবাঁধা রীতির বিরোধিতা করে বিস্তার লাভ করেছে সেটা নিজেই রীতি নীতিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে। চরম বিমুর্তিকরণের জন্য এ রীতির কাজগুলো বোধগম্য হচ্ছে না, আর শীতল যৌক্তিকতার জন্য হচ্ছে না উপভোগ্য। আর সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে "আন্তর্জাতিক রীতি” যে সকল ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলে পরিবেশন করা হয়েছে যে অঞ্চলের গভীর সাংস্কৃতিক ধারা, ইতিহাস এবং সামাজিক পরিমণ্ডলের প্রতি বহুলাংশেই সংবেদনশীল হতে পারেনি। আমাদের জন্য এটাই সবচেয়ে ভাববার বিষয়। এ নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন "নৌকা সব দেশেই নৌকা, বাংলাদেশের নৌকা, রথ সব দেশেই রথ; কিন্তু বর্মা দেশের নৌকা, বাংলাদেশের নৌকা, মিশর দেশের নৌকা, গ্রীস দেশের নৌকা সবার ভিন্ন ভিন্ন গঠন প্রণালী হয়েছে। ছাঁচ বদলায়, যান বাহন ইত্যাদির উপায় উপকরণ সবই বদলায়, অথচ নৌকা যে সে নৌকাই, রথ যে সে রথই থাকে…… শিল্প হল এমন জিনিস যা সর্বদেশে সর্বকালে সমান, ছাঁচ হল উপযুক্ত অনুপযুক্ত ভাল মন্দ ভিন্ন ভিন্ন।"
যে সংবেদনশীল মনোভাব modernism-এ অপ্রতুল বলে গণ্য সেটাই এখনকার স্থাপত্য চিন্তায় মুখ্য ব্যাপার। এটা এখন সত্য যে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাজ আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ছাঁচ এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার সাথে একাত্মতা লাভ করতে না পারছে ততক্ষণ আমাদের কাজ থাকছে অন্তঃসারশূন্য কাজগুলো কতগুলো প্রয়োজন মেটাবে সত্য বা হয়তো চমকও লাগাবে তবে কোন ক্রমেই অর্থবহ অথবা চিরন্তন স্থাপত্যের পর্যায়ে পৌঁছাবে না।
কথাটা যত সহজ করাটা তত দুরূহ। তবে এখন প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সেটা হল এই বাস্তবতার প্রতি বিশ্বাস এবং স্থাপত্যের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। আমাদের বুঝতে হবে যে শিক্ষার ভেতর আমাদের স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়েছে সেটা বেশ অসম্পূর্ণ। সত্তাবোধসম্পন্ন এবং অর্থবহ স্থাপত্য তৈরি করতে আমাদের বর্তমান অবস্থা অনেকটা অপর্যাপ্ত।
আমরা এখন দুটো বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে রয়েছে সমকালীন চাপ— আধুনিক উদ্ভাবন, নতুন সম্ভাবনা এবং প্রগতিশীল জীবন ধারণের ধ্যান-ধারনা। আর অন্য দিকে রয়েছে ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের গভীর ধারাবাহিকতায় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিজস্বতা । যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাজে এই দুই বাস্তবতা স্বীকৃতি না পাবে এবং এই দুইয়ের সম্মিলন না ঘটবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কাজ সৃজনশীল এবং ন্যূনতমভাবেও স্থাপত্য মণ্ডিত হবে না।